পরিবার ভিত্তিক মাছচাষ প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে একটি মৎস্য খামার বিদ্যালয় গঠন করে মাছ চাষির পরিবারের স্বামী ও স্ত্রীকে এক সঙ্গে মৎস্য প্রযুক্তির ব্যাবহারিক প্রয়োগ হাতে কলমে শেখানোর একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর নাম “ফিশারী ফ্যামিলি ফার্মিং ফার্ম স্কুল” (Fishery Family Farming Farm School)। স্কুলটি মাছচাষ সম্প্রসারণের নতুন একটি পদ্ধতি হিসেবে গ্রামীণ এলাকায় মাছচাষের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। এবছরের শুরুতেই ভারত বর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রথমবারের মত এমন দুটি স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। নতুন এই প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মাছ চাষি পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই অংশগ্রহণ করে। স্কুলে অংশগ্রহণকারী একজন মাছ চাষির মৎস্য খামারে সকল অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতিতে হাতে কলমে মাছ চাষের প্রযুক্তিগুলি শেখানো হয়। এ স্কুলে প্রতি ব্যাচে প্রায় ২৫ জনের মৎস্য চাষি পরিবারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহের সোমবার করে প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হওয়ায় এটি মাছচাষ প্রশিক্ষণের সাপ্তাহিক স্কুল হিসেবেও পরিচিতি পায়।
এতদিন সাধারণত মাছ চাষি হিসেবে পুরুষদের বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের আলাদাভাবে মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দেয়ার নানা কর্মসূচী পালিত হয়ে এসেছে। সেসব কর্মসূচীতে মাছের পরিচর্যার জন্য যে বিষয়গুলি আলোচিত হয় সেগুলির মধ্যে অনেক বিষয়াদি স্বামী ও স্ত্রীর বা পরিবারের অনান্য সদস্যের মতানৈক্যের জন্য অনেকাংশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না বিধায় সেসব কর্মসূচীর প্রাপ্তি কখনও কখনও যথাযথ মাত্রায় অর্জিত হতোনা। তাই উল্লেখিত ফ্যামিলি ফার্মিং ফার্ম স্কুলে একই পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই একসাথে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তাদেরকে পুকুরের পরিচর্যাসহ মাছচাষের বিভিন্ন প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক দিকগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়াকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে উৎসাহিত করা হয়। ফলে এ কার্যক্রম ফলপ্রসূ হবে বলে প্রত্যাশা করা যায় এবং এর ফলে গ্রামীণ এলাকার মাছচাষের সার্বিক উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্যামিলি ফার্মিং কনসেপ্ট তথা পরিবার ভিত্তিক খামার ধারণা সর্বজন গৃহীত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ধারণা। উপমহাদেশে নতুন হলেও এর মাধ্যমে মাছচাষ চর্চা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
ফিশারী ফ্যামিলি ফার্মিং কনসেপ্ট সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এবছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে (০২/০১/২০১৭ থেকে ০৬/০২/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত) পশ্চিমবঙ্গের পূর্বমেদিনীপুর জেলায় হলদিয়া ও সুতাহাটা ব্লকে দুটি সাপ্তাহিক স্কুল চলে। সুতাহাটা ব্লকের গোবিন্দপুর গ্রামে মাছ চাষি শান্তি বেরা ও হলদিয়া ব্লকের বাড়বাসুদেবপুর গ্রামের মাছ চাষি সুদীপ বিকাশ খাটুয়ার পুকুর সংলগ্ন স্থানে স্কুলের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। স্কুল দুটিতে উভয় ব্লক মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের মৎস্য চাষি পরিবার অংশগ্রহণ করে। ফ্যামিলি ফার্মিং স্কুলে হাতে কলমে মাছচাষের নানান পদ্ধতি শেখানো হয়। গ্রামের কোন জলাশয় পতিত ফেলে না রেখে প্রতিটিতেই যাতে মাছচাষ করা যায় সে উদ্যোগও নেওয়া হয়। মাসাধিক কাল ব্যাপী চলা এই ফ্যামিলি ফার্মিং স্কুলে প্রশিক্ষণ দেন মৎস্য দপ্তরের আধিকারিক ও মৎস্য বৈজ্ঞানিকগণ। শিবিরের প্রথম দিন উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় অন্তর্দেশীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের (সিফ্রি, ব্যারাকপুর) সায়েন্টিস্ট ডঃ অর্চন কান্তি দাস।
সম্মুখ প্রদর্শন হিসেবে শিক্ষার্থীদের একুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে গৃহস্থালি ভিত্তিক পুকুরে এক্যুয়াপনিক্স তথা জল-কৃষি বা মাছচাষ কিভাবে করা যায় তা আলোচনা করা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে এক্যুয়াপনিক্স বলতে এক্যুয়াকালচার ও হাইড্রোপনিক্স এর সম্মিলিত ব্যবস্থা তথা জলজ প্রাণী ও সবজির সমন্বিত চাষকে বোঝায়। এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতি সারা বিশ্বে একটি কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রযুক্তি নির্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, যা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ পরিসরে মাছ ও সবজির পরিবেশবান্ধব সমন্বিত চাষ পদ্ধতি বলে বিবেচিত। এই পদ্ধতি ভোক্তার স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্রামের বেশিরভাগ পুকুরই ছায়া যুক্ত। আর এসব পুকুরে এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে সঠিক ভাবে মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। ‘সমন্বিত মাছ ও সবজি চাষ’ প্রযুক্তি ছোট পুকুরে মাছ ও সবজি উৎপাদনের একটি লাভজনক পথ। এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করলে দু’বর্গমিটারে দশটি পর্যন্ত মাছ উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সনাতন পদ্ধতির চাষে পুকুরে খোল, সুপার ফসফেট, গোবর, ইউরিয়া দিয়ে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা উৎপন্ন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক মাছচাষের জন্য অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োজন। তাই পরিমাণ মতো বাজারে উপলব্ধ মাছের খাবারের উপাদান দিয়ে তৈরি কিছু কৃত্রিম খাবারও মাছকে দিতে হয়। আর অল্প পরিসরে মাছচাষের ফলে উৎপন্ন বর্জ্য মিশে সৃষ্ট দূষণের প্রতিকার হিসাবে বিজ্ঞানীরা দূষিত জল নিয়মিত বদলানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। জল বদলানোর কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হিসেবে তাঁরা পুকুরের দূষিত জল সব্জিচাষে এবং সব্জিচাষের জল সরাসরি সব্জিচাষে না দিয়ে পুকুরে প্রদান করার কথা বলছেন। এ পদ্ধতিতে পুকুর পাড়ে সব্জিচাষের কথা বলছেন তাঁরা। বর্জ্য মেশানো পুকুরের জলে নাইট্রোজেন ও ফসফেট থাকায় তা (সব্জিচাষে প্রদান করলে) উপকারী সারের কাজ করবে। পুকুর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল তুলে পাড়ের সব্জিচাষে ব্যবহার করতে হবে। আর যে ভূ-গর্ভস্থ জল সব্জিচাষে প্রয়োজন ছিল তা সব্জিচাষের পরিবর্তে পুকুরে দিতে হবে। এর ফলে একই পরিমাণ ভূ-গর্ভস্থ জল ব্যবহার করে অধিক মাছ ও সবজি সম্মিলিতভাবে চাষ করা সম্ভব হবে আর কমবে সব্জিচাষে সারের খরচ এবং ক্ষুদ্রাকার পুকুরও থাকবে দূষণ মুক্ত।
এক্যুয়াপনিক্সসহ আরও যেসব মৎস্য প্রযুক্তি এ স্কুলে শেখানো হয় সেগুলো হল-
- বাড়ির পুকুরে স্বল্প ব্যয়ে অধিক উৎপাদিত চাষযোগ্য মাছ চাষ পদ্ধতি। বিশেষত দ্রুত বর্ধনশীল কই, গিফট তেলাপিয়া, আমুর মাছ, রজত রুই, পাবদা ইত্যাদি।
- একুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে মাছ চাষ প্রযুক্তি।
- ছায়া যুক্ত পুকুরে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষের প্রযুক্তির প্রয়োগ পদ্ধতি।
- পুকুর প্রস্তুতিসহ মাছ মজুত কালীন ও মজুত পরবর্তী পরিচর্যা।
- পুকুরের জল ও মাটির ভৌত-রাসায়নিক গুনাগুণ ও মাত্রা নির্ণয়ের পদ্ধতি।
- মাছের নানা রোগব্যাধি, প্রতিকার ও প্রতিরোধে করণীয় ও পুকুরের সাধারণ কতিপয় সমস্যা ও সমাধান।
- বাণিজ্যিকভাবে মাছচাষ ও উৎপাদিত মাছ বিপণন এর কলাকৌশল।
- ব্যবসা ভিত্তিক স্বল্প ব্যয়ে মাছের খাবার তৈরির পদ্ধতি।
- দেশি বিলুপ্ত প্রায় মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও হ্যাচারি স্থাপন পদ্ধতি।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ফিশারী ফ্যামিলি ফার্মিং ফার্ম স্কুল দুটিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন হলদিয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি খুকুমনি সাহু ও সুতাহাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জনাব সেখ নূর আলম। স্কুলে শুরুর দিন উপস্থিত ছিলেন হলদিয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি খুকুমনি সাহু আর সুতাহাটা ব্লকের ছিলেন মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ শীপ্রা মণ্ডল। প্রশিক্ষণ শেষে মাছচাষিদের প্রশংসাপত্রসহ মাছের পোনা ও জলের পিএইচ নির্ণয়ে জন্য “পিএইচ পেপার” দেওয়া হয়। প্রত্যাশা করা যায় ফিশারী ফ্যামিলি ফার্মিং ফার্ম স্কুল শিরোনামের নতুন ধারার এ সম্প্রসারণ কার্যক্রম মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্মোচন করবে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের নতুন এক দিগন্ত।
Visited 1,499 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?