বাংলাদেশে রুই জাতীয় মাছের মধ্য বাটা (Labeo bata) অন্যতম। এ মাছের দেহ লম্বা ও সরু, পিঠ কালচে রঙের। পাখনা গুলোতে সুক্ষ দাগ উপস্থিত। দেহ আঁইশে ঢাকা। দেহের উভয় পাশে পার্শ্বরেখা অঙ্গ বিদ্যমান। সাধারণত চাষের পুকুরে এ মাছ সর্বোচ্চ ২৩ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে এ মাছ পাওয়া যায়। পুকুর, খাল, বিল, নদীনালা, ডোবা, হাওর বা বাঁওড় ইত্যাদি জলাশয়ে পানির নিচের স্তরে বাস করে। এ মাছ জলাশয়ের তলদেশের পচা উদ্ভিদ, প্রাণিকণা (প্ল্যাঙ্কটন), শ্যাওলা ও কাদামাটি খেয়ে থাকে। বর্ষাকাল হচ্ছে বাটা মাছের প্রজনন কাল। এসময়ে এরা স্রোতযুক্ত স্বাদু পানিতে ডিম পাড়ে। অন্যান্য রুই জাতীয় মাছের মত এরাও বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে না। এদেশে মাছচাষ খাতে মাছটির চাহিদা থাকায় বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ডিম ফোটানো তথা পোনা উৎপাদন করা হয়। এতে একদিকে যেমন পোনার উৎপাদন বাড়ছে অন্যদিকে সময়মত নির্ভেজাল পোনাও পাওয়া যায়।
পুরুষ ও স্ত্রী মাছ সনাক্তকরণ:
কৃত্রিম পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের জন্য প্রজনন উপযোগী স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্তকরণ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে প্রজনন মৌসুমে বাটা জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় যা দেখে প্রজনন ঋতুতে এ প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে সহজেই চেনা যায়।
পুরুষ মাছ | স্ত্রী মাছ |
প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাছের জনন ছিদ্র বর্ধিত হয় এবং সামান্য ভেতরের দিকে ঢুকানো থাকে। | স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রিয় স্ফীত ও নরম হয় তবে ভেতরে দিকে ঢুকানো থাকে না। |
পুরুষ মাছের জননেন্দ্রিয় সাধারণত সাদাটে হয়। | স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রিয় গোলাপি আভাযুক্ত বা লালচে রঙের হয়। |
প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাছের বক্ষ পাখনার (পেক্টোরাল ফিন) অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠ স্পর্শ করলে অমসৃণ ও খসখসে অনুভূত হয়। | স্ত্রী মাছের বক্ষ পাখনার অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠ স্পর্শ করলে মসৃণ, সমতল ও নরম অনুভূত হয়। |
বর্ষাকালে পুরুষ মাছের জননেন্দ্রিয়র কাছে চাপ দিলে ঘন দুধের মত সাদা পদার্থ জননেন্দ্রিয় পথে বেরিয়ে আসে। | স্ত্রী মাছকে মৃদু চাপ দিলে জননেন্দ্রিয় পথে দু’একটি ডিম দৃষ্টিগোচর হয় বা বেরিয়ে আসে। (তবে বেশি চাপে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বের হতে দেখা যায় তাই বেশি চাপ প্রয়োগ না করাই ভাল)। |
একই বয়সের পুরুষ মাছের দেহের আকার তুলনামূলকভাবে স্ত্রী মাছের চেয়ে ছোট। | একই বয়সের স্ত্রী মাছের দেহের আকার পুরুষ মাছের চেয়ে বড় হয়। |
প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাছের উদারাঞ্চল তথা পেট সাধারণত গোল, ফোলা ও নরম হয়। | স্ত্রী মাছের উদারাঞ্চল ডিমে ভর্তি থাকায় বেশ ফুলে উঠে যা জননেন্দ্রিয় ছিদ্র পর্যন্ত বর্ধিত হয়। অঙ্কীয়দেশে পেটের মধ্যে একটা স্পষ্ট খাঁজ দেখা যায়। |
বক্ষ পাখনা অপেক্ষাকৃত বড়, বহিঃস্থ রেখা পুরু ও সুস্পষ্ট। | বক্ষ পাখনা ছোট এবং অত্যধিক সবল নয়, বহিঃস্থ রেখা সরু হয়ে থাকে। |
ডিম নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া:
ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের পূর্বশর্ত হল ডিমগুলোকে অবশ্যই নিষিক্তকরণ সম্পন্ন করতে হবে। নিষিক্তকরণের জন্য শুক্রাণুকে ডিমের সংস্পর্শে আসতে হয়। অনিষিক্ত ডিম নষ্ট হয়ে যায় তাই তা দ্রুতই আলাদা করে ফেলে দিতে হয়।
কার্প হ্যাচারিতে সাধারণত দুটি ভিন্ন ধরণের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতিতে (artificial breeding method) ডিম নিষিক্তকরণ করা হয়ে থাকে। যথা-
ক. প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতি (induced breeding method)
খ. চাপ পদ্ধতি বা স্ট্রিপিং পদ্ধতি (Stripping method)
প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতি:
এই প্রক্রিয়ায় হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে ব্রিডিং ট্যাঙ্কে ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে পুরুষ ও স্ত্রী মাছ যথাক্রমে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছাড়ে। অতঃপর স্বাভাবিকভাবেই ডিম নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নিষিক্ত ডিম পরবর্তীতে হ্যাচিং জার বা হ্যাচিং পুলে স্থানান্তর করা হয় পরিস্ফুটনের জন্য। নিচে পর্যায়ক্রমিক ধাপের মাধ্যমে বিস্তারিত বর্ণনা করা হল-
- সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজে প্রতি কেজি বাটা মাছকে ১ এমএল পিজি হরমোন দেওয়া হয়।
- হরমোন ইনজেকশন দেয়ার পর স্ত্রী মাছকে ব্রিডিং ট্যাংকে রাখা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারা মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে।
- স্ত্রী মাছের মত পুরুষ মাছকেও হরমোন ইনজেকশন দেয়ার পর পৃথক একটি ব্রিডিং ট্যাংকে রাখা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারা মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে।
- স্ত্রী মাছের ডিম ছাড়ার ৩-৪ ঘণ্টা পূর্বে পুরুষ মাছকে স্ত্রী মাছের ব্রিডিং ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।
- স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের সংস্পর্শে এসে ডিম পাড়ে ও পুরুষ মাছ শুক্রাণু নির্গত করে। পরবর্তীতে শুক্রাণু দ্বারা ডিম নিষিক্ত হয়ে থাকে।
- পরিস্ফুটনের জন্য নিষিক্ত ডিমের পানি শোষণ (ওয়াটার হার্ডেনিং) সম্পূর্ণ রূপে শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা প্রয়োজন নতুবা ডিম নষ্ট হয়ে যায়। পানি শোষিত নিষিক্ত ডিম জুগার জার বা হ্যাচিং পুলে স্থানান্তর করা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারার মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে। এখানেই পরিস্ফুট সম্পন্ন হয়।
- অন্যদিকে ডিম ও শুক্রাণু নিঃশেষিত মাছগুলিকে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন (যেমন প্রতি কেজি মাছের জন্য ০.২ সিসি হারে রেনামাইসিন) প্রয়োগ করার পর একটি নির্দিষ্ট পুকুরে স্থানান্তর করা হয় পরবর্তীতে ব্রুড মাছ হিসেবে পুনরায় ব্যবহারের জন্য। এসময় তাদের বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
- ডিম ছাড়ার ১৬-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে পোনা বের হয়।
- ডিম ফুটে পোনা বের হওয়ার পর ডিমের খোলস পচতে শুরু করে বিধায় এসব পোনাকে (এই পোনা ডিমপোনা নামে পরিচিত) অন্য একটি পরিষ্কার জারে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
- ডিমের পানি শোষণ হওয়ার পর থেকে ডিম পোনার কুসুমথলি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনবার ০.১-০.২ পিপিএম মাত্রার ম্যালাকাইট গ্রিন দ্বারা ডিম বা ডিমপোনা শোধন করতে হয়। এরফলে ডিম বা ডিমপোনা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয় থেকে রক্ষা পায়।
চাপ পদ্ধতি বা স্ট্রিপিং পদ্ধতি:
- প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতির মত এ পদ্ধতিতেও প্রথমে হরমোন ইনজেকশন দেওয়ার পর স্ত্রী মাছকে ব্রিডিং ট্যাংকে রাখা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারা মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে।
- স্ত্রী মাছের মত পুরুষ মাছকেও হরমোন ইনজেকশন দেয়ার পর পৃথক একটি ব্রিডিং ট্যাংকে রাখা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারা মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে।
- ডিম পাড়ার সময় হলে স্ত্রী মাছকে ট্যাংক থেকে জালের সহায়তায় সংগ্রহ করে প্রথমে শুকনো কাপড়ের সাহায্যে মুছে নেয়া হয়। এরপর পেটে সামান্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি পাত্রে ডিম সংগ্রহ করা হয়।
- এর পরপরই পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিয়ে বীর্য পূর্বে সংগৃহীত ডিমের উপর ফেলা হয় এবং একই সাথে মুরগীর নরম পালক দিয়ে বীর্যকে ডিমের সংগে মিশিয়ে দিতে হয় যাতে ডিমগুলো ভালভাবে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হতে পারে।
- নিষিক্ত ডিমে ক্রমান্বয়ে পানি দিয়ে ডিমের পানির শোষণ সম্পূর্ণভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
- পানি শোষিত নিষিক্ত ডিমকে হ্যাচিং জার তথা হ্যাচিং পুলে স্থানান্তর করা হয় যেখানে কৃত্রিম স্রোত ও ফোয়ারার মাধ্যমে এরিয়েশনের ব্যবস্থা করা থাকে। এখানেই পরিস্ফুট সম্পন্ন হয়।
ডিম পরিস্ফুটন পদ্ধতি:
২৫০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ইনকিউবেটরে ৩০০-৩৫০ গ্রাম শুষ্ক ডিম রাখা সম্ভব। অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রতি মিনিটে ১০-১৫ লিটার পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। পানি নির্গমন পাইপে ছাঁকনি দিয়ে পানি বের করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখতে হয়। মাছের প্রজাতি এবং তাপমাত্রার উপর ডিম ফুটার সময়কাল নির্ভর করে। রুই জাতীয় মাছের মত বাটা মাছের ক্ষেত্রেও সাধারণত রুই জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে ১৪-১৫ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে থাকে কিন্তু বাটা মাছের জন্য ১৬-২০ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। ডিম ফুটা শেষ হলে ডিম পোনা ডিমের খোলস থেকে বের হওয়ার পর সাঁতার কাটা শুরু করে। এবং সাধারণত ডিম ফুটানোর চৌবাচ্চার তলায় অবস্থান করতে থাকে। এসময় ডিম পোনাগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হয়।
ডিম পরিস্ফুটনকালীন সতর্কতা:
- পাঁচ শতাংশ ডিম ফুটে পোনা বের হলে পানির প্রবাহ ঠিক ১০ মিনিট বন্ধ করে রেখে আবার চালু করতে হবে। ফলে সব ডিম দ্রুত ফুটে পোনা বের হয়।
- ডিম ফুটে পোনা বের হওয়ার পর ডিমের খোলস পচতে শুরু করে। তাই দ্রুতই ডিমপোনাকে অন্য পরিষ্কার জারে সরিয়ে নেওয়া উচিত।
- ডিমের পানি শোষণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর থেকে ডিম পোনার কুসুমথলি নিঃশোষিত না হওয়া পর্যন্ত তিন বার ০.১-০.২ পিপিএম মাত্রার ম্যালাকাইট গ্রিন দ্বারা ডিম বা ডিম পোনা শোধন করতে হবে। এর ফলে ডিম বা ডিম পোনা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
ডিমের পরিস্ফুটন না হওয়ার কারণসমূহ:
- পানিতে অধিক মাত্রায় আয়রন থাকা
- ডিম ছত্রাক বা অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা আক্রান্ত হওয়া
- ব্যবহৃত পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পরিমাণ কম থাকা
- ব্যবহৃত পানির তাপমাত্রা অধিক থাকা
- ব্যবহৃত পানি দূষিত হওয়া
- ডিম অপুষ্ট থাকা
- হ্যাচিং জার/হ্যাচিং পুলে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ডিম প্রদান
- আন্তঃপ্রজাতি প্রজনন
- অপরিপক্ব বা অধিক বয়স্ক ব্রুড মাছ ব্যবহার
- হ্যাচারিতে ব্যবহৃত সকল প্রকার জলাধার ও দ্রব্যাদি শোধন/জীবাণুমুক্ত না করা
- এই কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট জনবলের অজ্ঞতা বা অবহেলা।
রেণু পোনার পরিচর্যা:
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্ব শর্ত হল রেণু পোনার সঠিক পরিচর্যা। কার্প হ্যাচারিতে দুটি কৃত্রিম প্রজনন সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয়। এগুলো হল- প্রণোদিত প্রজনন ও চাপ প্রয়োগ পদ্ধতি। উভয়ক্ষেত্রেই ডিমপোনা উৎপাদন থেকে বিপণনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করা হয়। এর মধ্যে রেণু পোনার পরিচর্যার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাচারিতে ডিমপোনার কুসুমথলি নিঃশেষ হওয়ার পর থেকে পোনার আকার দৈর্ঘ্যে সাধারণত ১-১.৫ সেমি হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে রেণু পোনা বলা হয়। এ অবস্থায় এরা খুবই নাজুক ও সংবেদনশীল হয়ে থাকে। ডিমপোনা ও রেণু পোনার সঠিক পরিচর্যার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়:
- সঠিক ঘনত্বে মজুদ
- সাইফনিং করা
- প্রাথমিক খাদ্য সরবরাহ (রেণু পোনার জন্য)
- সঠিক মাত্রায় পানির প্রবাহ
- রোগবালাই ও তার প্রতিকার ব্যবস্থাপনা
হ্যাচিং ট্যাংক ও হ্যাচিং জারে সঠিক ঘনত্বে পোনা মজুদ:
ডিম যেখানেই ফুটানো হোক না কেন যেমন হ্যাচিং ট্যাংক, সার্কুলার ট্যাংক বা বোতল জার ইত্যাদিতে সঠিক ঘনত্বে মানসম্মত পোনার মজুদ নিশ্চিত করতে হয়। এ অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ১০০০ টি পোনার মজুদ করা উত্তম। এতে পোনার স্বাভাবিক চলাচল, অক্সিজেন ও খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। ফলে পোনা নির্বিঘ্নে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
অন্যভাবে বলা যায়, ২৫০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার জারে কার্প জাতীয় মাছের পোনা ৩০০-৩৫০ গ্রাম মজুদ করা যেতে পারে। হ্যাচিং জারে ৫পিপিএম অক্সিজেন সমৃদ্ধ পানির প্রবাহ বজায় রাখতে হয়। পানির তাপমাত্রা অনুকূল মাত্রায় (সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) রাখতে হয়। সার্কুলার ট্যাংকে প্রতি লিটার পানির হিসাবে সর্বাধিক ৫ গ্রাম পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
সাইফনিং প্রক্রিয়ায় আবর্জনা অপসারণ:
সদ্য প্রস্ফুটিত ডিমপোনার জারে ডিমের খোসা, অনিষিক্ত ডিম, মৃত ডিমপোনা ইত্যাদি ময়লা-আবর্জনা দেখতে পাওয়া যায়। এসবের উপস্থিতি সমস্ত পোনারই রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই নিষিক্ত ডিম ফুটে ডিমপোনা বের হওয়ার সাথে সাথে সাইফনিং পদ্ধতিতে ডিমের খোসা, অনিষিক্ত ডিম, মৃত ডিমপোনা ইত্যাদি ময়লা আবর্জনা সাইফনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিষ্কার করা হয়। এছাড়াও ডিমপোনা রেণু পোনায় পরিণত হওয়ার পর থেকে প্রতিবার খাদ্য প্রয়োগের পূর্বে সাইফনিং করে খাদ্যজনিত ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা উচিত। অনেক সময় উচ্ছিষ্ট খাদ্য এবং মৃত রেণু পচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে। তাই ময়লা আবর্জনা অপসারণে কখনই অবহেলা করার উচিত নয়।
সাইফনিং শুরু পূর্বে ট্যাংকের পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিতে হবে। পানির প্রবাহ বন্ধ থাকার ফলে ডিমের পরিত্যক্ত খোলস ও ময়লা ট্যাংকের তলদেশে জমা হয়। অতি দ্রুততার সাথে সাইফনিং করে নানাবিধ ময়লা-আবর্জনা জার বা ট্যাংকের পানি হতে পরিষ্কার করে নিতে হয়। এভাবে কিছুক্ষণ পর পর সাইফনিং পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে পানি পরিষ্কার করলে পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় ময়লা থাকে না। একইভাবে হ্যাচিং জারের পানি প্রবাহ বন্ধ করা হলে ডিমের পরিত্যক্ত খোলসসহ অন্যান্য ময়লা জারের নিচে জমা হয়। জারের নিচে পানির সরবরাহ পাইপ খুলে নিচে খোলসসহ জমাকৃত ময়লা পরিষ্কার করা যেতে পারে।
হ্যাচিং ট্যাংক ও হ্যাচিং জারে সঠিক মাত্রায় পানির প্রবাহ:
সদ্য ফোটা ডিমপোনা ও রেণুপোনার অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেশি। এরা সহজেই দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে না। তাই ডিমপোনা ও রেণু পোনার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক। এছাড়া এদের ভাসিয়ে রাখার জন্য দরকারি পানি প্রবাহ চালু রাখা। প্রজাতি, রেণুর আকার ও বয়স অনুযায়ী এই প্রবাহের মাত্রা ও দিক (উপর বা নিচে) নির্ভর করে। যেমন সরপুঁটির রেণু এবং কম বয়সের রেণু অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল হওয়ায়, বোতল বা হ্যাচিং জারের নিচে থেকে হালকাভাবে পানি প্রবাহ চালু রাখতে হয়। আবার অন্যান্য সকল প্রজাতির এবং বেশি বয়সের রেণুর ক্ষেত্রে উপর থেকে ঝরনা ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় উপর ও নিচ দুদিক থেকেই পানি প্রবাহ চালু রাখা যেতে পারে।
রেণু পোনা সংগ্রহ ট্যাংক ও সঠিক মাত্রায় রেণু সংগ্রহ:
হ্যাচারিতে সাধারণত সার্কুলার ট্যাংক, আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংক অথবা হাঁপায় রেণু পোনা বিক্রির জন্য রাখা হয়। এ সকল ট্যাংক বা হাঁপায় সঠিক ঘনত্বে রেণু পোনা রাখতে হবে। সার্কুলার ট্যাংকে সর্বাধিক প্রতি ঘনমিটার পানিতে ০.৫ কেজি রেণু রাখা যেতে পারে। একই আকারের হাঁপাতেও সমপরিমাণ রেণু রাখা যেতে পারে। তবে প্রতি ৮-১০ ঘণ্টা পর পর সাইফনিং করে মৃত রেণুসহ অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা আবশ্যক।
প্রাথমিক খাদ্য সরবরাহ:
বাটা মাছের নিষিক্ত ডিম ফুটতে সাধারণত ১৬-২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। ২৫-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ডিম ফুটে ডিমপোনা বের হয়। এ অবস্থায় এদের সাথে কুসুম থলি থাকে। এরা কুসুম থলি থেকে পুষ্টি পায়। ডিম ফুটার ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে কুসুম থলি মিলিয়ে যাওয়ার পর এদেরকে বাহির থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এ অবস্থায় এদেরকে রেণু পোনা বলে আর এদেরকে যে খাদ্য সরবরাহ করা হয় তাকে প্রাথমিক খাদ্য বলে। প্রাথমিক খাদ্যের প্রকার ও চাহিদা প্রজাতিভেদে ভিন্ন হয়। প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে হাঁস-মুরগির ডিমের কুসুম অথবা জীবন্ত খাবার (জুপ্লাঙ্কটন) দেয়া হয়। প্রতি ৪ ঘণ্টা পর পর প্রতি ৫ লক্ষ রেণু পোনার জন্য একটি সিদ্ধ ডিমের কুসুম ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করার পর কাপড়ে ছেঁকে খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করা যায়।
সাধারণত প্রাথমিক খাদ্য প্রয়োগের ২-৩ দিন পরে রেণু পোনা নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়।
তথ্যসূত্র:
In English:
Ahmed ATA (1997) Disease problems in carp and shrimp hatchery. In: Hasan MR, Rahman MM and Sattar MA (eds) Quality Assurance in Induced Breeding. Department of Fisheries, Jessore. pp. 23-30.
Ananda JN (1973) Experiment on induced breeding of Indian major carp by pituitary hormone injection in Uttar Prodesh. Journal of the Inland Fisheries Society of India. 5: 37-45.
Ara F (1998) Determination of Fertilization and Hatching Rates of Different Culturable Species, M.S. Thesis submitted in Fisheries and Marine Resource Technology Discipline, Khulna University.
Atz JW and Pickford GE (1959) The use of pituitary hormones in fish culture. Endeavour, 18(71):125-129.
Chaudhury H (1960) Experiments on induced spawning of Indian carps with pituitary injections. Indian Journal of Fisheries, 7(1): 20-48.
Jhingran VG and Pullin RSV (1990) A hatchery manual for the common Chinese and Indian major carps. Asian Development Bank. International Center for Living Aquatic Resources Management. pp. 1-58.
বাংলায়:
আমিনুল ইসলাম ও মো জসীম উদ্দিন (২০১৭) আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ ও পুকুরপাড়ে ফসল চাষ ব্যবস্থাপনা। পৃষ্ঠা ৫৪-৭০।
এ কে এম আহসান কবীর (২০১৫) মৎস্য চাষে আধুনিক পদ্ধতি। দি ইউনভারসেল একাডেমি, ৪০-৪১ বাংলাবাজার, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৩৭-৬১।
এ. কে এম জহুরুল ও কাজী মাহবুবুল হক (২০০৯) আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ। সময় প্রকাশন, ৩৮/২ ক বাংলা বাজার, ঢাকা। পৃষ্ঠা ১৬১-১৯২।
কামাল সিদ্দিকী ও সমরেন্দ্র নাথ চৌধুরী (১৯৯৬) মৎস্য: পুকুরে মাছ চাষ ম্যানুয়েল। ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব লোকাল গভর্ণমেন্ট, আগারগাঁও, শেরে বাংলানগর, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৪৭-৫২।
নরেশ মেহান চক্রবর্তী (১৯৮৮) মাছের প্রনাদিত প্রজনন ও বীজ সৃষ্টি। আনন্দ এজেন্সী, কলিকাতা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (২০১৭) বিপন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষ কৌশল। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ। পৃষ্ঠা: ৩১-৩৩।
মজিদ এম এ (১৯৯২) সম্প্রসারণ কর্মীদের জন্য ব্রুড মাছ ও হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ পুস্তিকা। মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট, ময়মনসিংহ।
মৎস্য অধিদপ্তর (১৯৯২) ছোট হ্যাচারী। মৎস্য অধিদপ্তর, ঢাকা, ১৯৯২।
মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট (১৯৯৫) বাংলাদেশে মাছের কৃত্রিম প্রজননে কৌলতাত্ত্বিক সমস্যা। মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট, ময়মনসিংহ।
Visited 2,184 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?