বাড়িতে তৈরি করা ছোট মাছের শুঁটকি
বাড়িতে তৈরি করা ছোট মাছের শুঁটকি

আমরা অনেকেই শুঁটকি মাছ পছন্দ করি। প্রায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরের এমনটি গঞ্জের হাট-বাজারেও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা শুঁটকি মাছ কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেরই শুঁটকি খাওয়া প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বাজারের শুঁকটি কিনে খেতে চান না। কারণ প্রথমত সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাজারে প্রাপ্ত শুঁটকি তৈরি ও সংরক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কীটনাশক তথা বিষ মেশানো হয়ে থাকে যা নিশ্চিতভাবেই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যদিও এসব বিষের বিষক্রিয়ার কার্যকাল সুনির্দিষ্ট থাকে এবং বিষক্রিয়ার কার্যকাল শেষ হবার পর তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য আর ততটা ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেয় না। কিন্তু অনেক কীটনাশকের বিষক্রিয়ার কার্যকাল বেশী হয়ে থাকে আবার একজন ক্রেতার পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যে তার ক্রয় করা শুঁটকিতে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে তার ক্রিয়ার কার্যকাল শেষ হয়েছে কিনা। এছাড়া আমাদের দেশে এখনও বেশিরভাগ শুঁটকি সনাতন পদ্ধতিতে তথা রাস্তার পাশে অথবা নদী/সমুদ্রের চর এলাকায় খোলা আকাশের নীচে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় ফলে এসব শুটকিতে একদিকে যেমন ধুলাবালির আধিক্য লক্ষ করা যায় তেমনই কীট-পতঙ্গ বা এর দেহাংশ অথবা ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশী থাকে যা নিশ্চিতভাবেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আবার আপনি যে মাছের শুঁটকি পছন্দ করেন সে মাছের শুঁটকি সবসময় বাজারে পাওয়া যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতেও শুঁকটি প্রেমীরা শুঁটকী খাওয়া থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছুক নন। তাই শুঁটকিপ্রেমীদের মধ্যে যাদের সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি করা বাজারের এসব শুঁটকি খেতে মন চায় না তারা খুব সহজে বাড়িতেই তৈরি করে নিতে পারেন তাদের পছন্দের মাছের শুটকি। এজন্য যে সব উপকরণের প্রয়োজন হবে তার প্রায় সবগুলোই আপনার বাড়িতেই অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়, তাই মাছ ছাড়া অন্যান্য উপকরণ কেনার বাড়তি কোন ঝামেলা ছাড়াই তৈরি করে নিতে পারেন আপনার পছন্দের শুঁটকি।

 

পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি:

  • আপনি যদি সারা বছরের প্রয়োজনীয় শুঁটকি তৈরির পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে বেছে নিন বর্ষা পরবর্তী সময়কালকে। বর্ষার পানি নেমে যাবার সময় আমাদের নদী ও বিলে প্রচুর মাছ ধরার পরে। এসময় মাছের দামও থাকে তুলনামূলক কম।
  • অল্প পরিসরে শুঁটকি করতে চাইলে বর্ষা ছাড়া বছরের যে কোন সময়েই আপনি শুঁটকি তৈরি করতে পারেন।
  • আপনি আপনার নিকটবর্তী ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার (যেখানে নদী বা বিল থেকে ধরে আনা মাছ জেলেরা নিলামের মাধ্যমে পাইকারি দরে বিক্রি করে থাকে) থেকে অনেক কম দামে মাছ কিনতে পারেন।
  • মাছ কেনার আগেই আগাম দেখে দিন কয়েক দিনের আবহাওয়ার খবর (বিবিসি বাংলা বা এজাতীয় বেশ কিছু আন্তর্জাতিকমানের ওয়েবসাইটে আপনি তা পেতে পারেন)। কারণ শুঁটকি তৈরির জন্য কমপক্ষে ৫-৬ দিন কড়া রৌদ্রের প্রয়োজন হবে। উজ্জ্বল রৌদ্রের ন্যুনতম নিশ্চয়তা না থাকলে বিড়ম্বনা এড়াতে মাছ কেনা থেকে বিরত থাকুন এবং ভাল আবহাওয়ার নিশ্চয়তা পেলে মাছ কেনার সিদ্ধান্ত নিন।
  • বাজার থেকেই মাছের আঁইশ ও নাড়ি-ভুঁড়ি ফেলে কাঙ্ক্ষিত আকারে কেটে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ ও বিবেচ্য বিষয়াবলী:

  • প্রতি কেজি মাছের জন্য প্রয়োজন হবে এক চা চামচ লবণ, ১/২ চা চামচ হলুদের গুড়া, ১/২ চা চামচ মরিচের গুড়া এবং চিকন জি.আই. তার (যা গুনা নামেই অধিক পরিচিত)।
  • তারের বিকল্প হিসেবে শক্ত সুতা ব্যবহার করতে পারেন। তার বা সুতা ব্যবহার করতে না চাইলে বাঁশের তৈরি চালুনি, ঢেউটিন, প্লেট সিট, মাদুর, চাটাই ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
  • কাক জাতীয় পাখি, পতঙ্গ, বিড়াল ইত্যাদি শুঁকটি প্রিয় প্রাণী থেকে শুঁটকিকে রক্ষা করতে মশারি ব্যবহার করুন। মশারি ধুলা-বালি থেকেও আপনার মাছের শুঁটকিকে অনেকাংশেই রক্ষা করবে।
  • বাড়ির উঠানে বা ছাদে সহজেই আপনি এটি করতে পারেন। ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করলে বাড়ির মালিকে আগেই জানিয়ে রাখুন বা তাকে আপনার শুঁটকি তৈরির সঙ্গী করে নিন।

 

শুঁটকি তৈরির পদ্ধতি:

  • প্রথমেই আঁইশ ও নাড়ি-ভুঁড়ি ফেলে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন*।
  • এরপর বড় মাছের ক্ষেত্রে পাতলা পাতলা করে ছোট ছোট টুকরা করে নিন, মাঝারি থেকে ছোট মাছের ক্ষেত্রে মাথা, ধর, লেজ ইত্যাদি অংশে টুকরা করে নিতে পারেন। আর খুব ছোট মাছের ক্ষেত্রে (যেমন-পুঁটি) গোটাই রাখুন তবে দ্রুত শুকানোর জন্য চিড়ে দিতে পারেন*।
  • এবার মাছ থেকে পানি ঝরিয়ে হলুদ, মরিচ ও লবণ দিয়ে মেখে তারে বা শক্ত সুতায় গেঁথে রোদে শুকাতে দিন। শক্ত সুতায় গাঁথতে বড় আকারে সুই ব্যবহার করুন। তার বা সুতা ব্যবহার করতে না চাইলে চালুনিতে ফাঁকা ফাঁকা করে মেলে দিন।
  • এভাবে ৫-৬ দিন কড়া রোদে শুকিয়ে নিন।
  • * এ দুটি কাজ বাজার থেকেই কাউকে দিয়ে করিয়ে নিন, খরচ সামান্য বাড়লেও ঝামেলা অনেকটাই কমে যাবে।

 

শুঁটকি সংরক্ষণের পদ্ধতি:

  • শুকনো মাছ তথা শুটকি ঠাণ্ডা করে প্লাস্টিক বা টিনের কৌটায় ভরে রাখুন। খেয়াল রাখুন কৌটায় যেন কোন ছিদ্র না থাকে। এছাড়াও শুঁটকি প্রথমে পলিথিন প্যাকেটে ভরে প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে কৌটায় রাখতে পারেন।
  • মাঝে মধ্যে কৌটা থেকে শুঁটকি বের করে রোদে দিন। পুনরায় ঠাণ্ডা করে কৌটায় ভরে রাখুন। কোন অবস্থাতেই গরম শুটকি প্যাকেট বা কৌটায় ভরবেন না।
  • পোকামাকড়ের হাত থেকে শুঁটকিকে রক্ষা করতে কৌটায় কিছু নিমের শুকনা পাতা অথবা কয়েকটি শুকনা মরিচ রেখে দিন।
  • যা আপনার তৈরি শুটকির সংরক্ষণকালকে দীর্ঘ করতে সহায়ক হবে।

Visited 4,727 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
বাড়িতেই তৈরি করুন আপনার পছন্দের মাছের শুঁটকি

Visitors' Opinion

আয়েশা আবেদীন আফরা

প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বি.এস-সি. ফিশারিজ (অনার্স) ৬ষ্ঠ ব্যাচ (সেশনঃ২০০৪-২০০৫), শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ফিশারীজ কলেজ মেলান্দহ, জামালপুর। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.