ওপাহ (Opah, Lampris guttatus): উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট মাছ
ওপাহ (Opah, Lampris guttatus): উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট মাছ

মাছ শীতলরক্ত বিশিষ্ট প্রাণী (ectothermic animal)। এরা নিজের দেহের তাপমাত্রা নিজেরা অভ্যন্তরীণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বিধায় পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের দেহের তাপমাত্রাও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ এদের শরীরের তাপমাত্রা সুনির্দিষ্ট নয় বরং পরিবেশের তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল। এতদিন বিজ্ঞানীরা এমনটাই ধারনা করতেন। কিন্তু এতদিনের সেই ধারনায় পরিবর্তন এনে দিলেন আমেরিকার মৎস্য জীববিজ্ঞানী নিকোলাস ওয়েগনার (Nicholas Wegner)। তিনি ও তার গবেষণা দল Science নামক বিজ্ঞান পত্রিকায় “Whole-body endothermy in a mesopelagic fish, the opah, Lampris guttatus” শিরোনামে প্রতিবেদনে দাবী করেছেন অপাহ মাছ (যার বৈজ্ঞানিক নাম Lampris guttatus) সম্পূর্ণরূপে উষ্ণরক্ত (endothermic) বিশিষ্ট [1]। মাছটি ওপাহ ছাড়াও ক্রাভো (cravo), মুনফিশ (moonfish), কিংফিশ (kingfish), জেরুজালেম হ্যাডোক (Jerusalem haddock) ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

Opah, Lampris guttatus
Fisheries biologist Nick Wegner holds an opah caught during a research survey off the California coast (Photo: wikimedia, Copyright: public domain)

পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডলীয় এবং ক্রান্তীয় এলাকার সাগর-মহাসাগরের গভীর জলে এদের দেখা মিলে। সমুদ্রের এই মাছ ১৩০০ ফুট বা প্রায় ৪০০ মিটার গভীরে চারপাশের শীতল পানিতেও নিজেদের শরীরের তাপমাত্রাকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে রাখতে পারে [2]। সাঁতারের সময় এরা বক্ষপাখনা (pectoral fin) অনবরত সঞ্চালনের মাধ্যমে অধিকাংশ তাপ উৎপাদন করে। এছাড়াও ফুলকা থেকে দেহের দিকে আসা রক্তবাহী নালিকা থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ ঠাণ্ডা রক্ত দেহ থেকে ফুলকায় প্রবাহিত নালিকার অক্সিজেন বিহীন উষ্ণ রক্তের সংস্পর্শে এসে উষ্ণ হয়। যা প্রতি-স্রোত তাপ বিনিময় কৌশল (Counter-current heat exchange mechanism) নামে পরিচিত। এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ চর্বি স্তরের তাপ অপরিবাহী অংশের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে দীর্ঘ সময় ধরে আশপাশের পরিবেশ থেকে তাদের শরীরকে ২-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর মতো অধিক উষ্ণ রাখতে পারে [3]। এর ফলে এরা গভীর সাগরের শীতল পরিবেশে যেখানে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও কম সেখানেও বেঁচে থাকতে পারে [4], সেইসাথে দীর্ঘ ডুবে (dive) প্রখর দৃষ্টিতে ক্ষিপ্রতার সাথে শিকারকে তাড়া করতে পারে।

ওপাহ সাধারণত স্কুইড, ক্রিল (চিংড়ির মত দেখতে ছোট প্রাণী) ও অন্যান্য ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং নিজেরাও আবার বড় সাদা সার্ক, ম্যাকও সার্ক এমন কি মানুষের রসনার শিকার হয়। এরা লম্বায় প্রায় ২ মি. (৬.৬ ফুট) এবং ওজনে ২৭০ কেজির মতো হতে পারে [5]। লঙ লাইন পদ্ধতিতে টুনা আহরণের সময় প্রায়শই এরা অনাকাঙ্ক্ষিত (by-catch) হিসেবে ধরা পরে [4]। এদের হালকা সুঘ্রাণ বিশিষ্ট গোলাপি-কমলা মাংস আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে হাওয়াই (Hawaii) এর রেস্টুরেন্টসমূহে সুশি (sushi) এবং সাশিমি (sashimi) নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে [5]।

এর আগে জীববিজ্ঞানীরা কয়েক প্রজাতির টুনা (Tuna), ম্যাকরল হাঙ্গর (Mackerel Sharks) ও সোর্ড ফিশ (Sword fish) খুঁজে পেয়েছিলেন যারা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর মতই দেহের তাপ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবে তা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট বলতে ঠিক যা বোঝায় সেরকম নয়। বরং এদের কারও কারও দেহের অভ্যন্তরের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ তাপ উৎপাদন করতে পারে আবার কেউ কেউ দেহের তাপ যাতে না হারায় সে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে অন্যান্য শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর মত এদের দেহের তাপ দ্রুত পরিবেশের পরিবর্তিত তাপমাত্রার সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায় না। যেমন নীল পাখনা টুনা মাছ দেহের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত তাপ উৎপাদনের জন্য অন্যান্য টুনা মাছের চেয়ে বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে। বৃহদাকার হলুদ পাখনা টুনা মাছ দীর্ঘ ও দ্রুতগতির সাঁতারের সময় কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরে তাপ উৎপন্ন করতে পারে। আবার দেহস্থ তাপ যাতে সহজে হারিয়ে না যায় তার জন্য বিশেষ কৌশল গ্রহণ করে থাকে। অন্যদিকে সোর্ড ফিশে এক ধরণের কলা বা টিস্যু রয়েছে যেগুলো তাপ উৎপাদন করতে পারে। এই কলা হিটার হিসেবে কাজ করে। এদের রক্ত চোখ ও মস্তিষ্কে যাবার পথে এই হিটার তুল্য কলা রক্তকে উষ্ণ করে থাকে। যাই হোক কোন কোন বিজ্ঞানী এদেরকে উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর বৈশিষ্ট্য ধারণকারী হিসেবে বর্ণনা করলেও এরা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর স্বীকৃতি পায়নি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে দেহের উষ্ণতা ধরে রাখতে সক্ষম ওপাহ মাছ উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট প্রাণীর মর্যাদা পায় কিনা তাই এখন দেখার বিষয়।

 

তথ্যসূত্র:

  1. Wegner NC, Snodgrass OE, Dewar H and Hyde JR (2015) Whole-body endothermy in a mesopelagic fish, the opah, Lampris guttatus. Science. 348 (6236). p. 786-789. DOI: 10.1126/science.aaa8902
  2. Pappas S (2015) First Warm-Blooded Fish Found. LiveScience.com. Retrieved on 25 May 2015 and from http://www.livescience.com/50839-first-warm-blooded-fish-found.html
  3. Yong Ed (2015) Meet the Comical Opah, the Only Truly Warm-Blooded Fish. National Geographic. Retrieved on 25 May 2015 and from http://phenomena.nationalgeographic.com/2015/05/14/meet-the-comical-opah-the-only-truly-warm-blooded-fish/
  4. Bray D (2015) Opah, Lampris guttatus. Fishes of Australia. Retrieved on 25 May 2015 and from http://www.fishesofaustralia.net.au/Home/species/1870
  5. Wikipedia (2015) Opah. Wikipedia: the free encyclopedia. Retrieved on 25 May 2015 and from http://en.wikipedia.org/wiki/Opah

Visited 1,070 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
ওপাহ (Opah, Lampris guttatus): উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট মাছ !

Visitors' Opinion

Tagged on:                                                         

মোঃ সোহেল পারভেজ

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনষ্টিটিউট, পেঁচারদ্বীপ, রামু, কক্সবাজার, বাংলাদেশ। M.S. in Oceanography, Dept. of Oceanography, University of Dhaka, Bangladesh. M.S. & B.Sc. (Hons) in Marine Science, Institute of Marine Sciences and Fisheries, University of Chittagong, Bangladesh. Contact Email: msparvez191@gmail.com. বিস্তারিত...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.