বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু একটি মাছ, যার নাম ইলিশ। শুনলেই ভোজন রসিক বাঙ্গালীর জিভে জল এসে যায়। এ মাছে রয়েছে ৫৩.৭ ভাগ পানি, ১৯.৪ ভাগ চর্বি, ২১.৮ ভাগ আমিষ এবং অবশিষ্টাংশ বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। ইলিশে পাওয়া যায় শতকরা ৬০ ভাগ খাওয়ার উপযোগী flash বা মাছ। ইলিশে বিদ্যমান ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মানুয়ের রক্তের কোলস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে, ফলে হৃদরোগের ঝুকি কমাতে সাহায্য করে। এ মাছের আমিষে ৯ ধরনের এমাইনো এসিড পাওয়া যায় যা মানুষের পাকস্থলীতে তৈরী হতে পারে না। এছাড়া ইলিশে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদির পাশাপাশি ভিটামিন এ, ডি এবং কিছু পরিমাণ ভিটামিন বি পাওয়া যায়। ইলিশের স্বাদ এবং গন্ধ নির্ভর করে তার তেলের উপর এবং এর দেহস্থ সুঘ্রাণ ও ভাজার সময়ের ঘ্রাণ আশেপাশের মানুষের নাগের ডগায় কেন যে ছড়িয়ে পড়ে তার কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া না গেলেও ইলিশ নিঃসৃত সুগন্ধি পার্থিব অনেক সুগন্ধিকেই হার মানায় নিঃসন্দেহে। আর সমুদ্র পাড়ের সে ইলিশ যদি এসে ধরা দেয় আমাদের স্বাদু পানি বেষ্টিত বিশাল গোলাকার চৌবাচ্চা সদৃশ বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে তাহলে কেমন হয়!
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন স্বাদু পানির মৎস্য ভাণ্ডার বলে খ্যাত সিলেটের হাকালুকি হাওরে এ বছর (জুন) প্রচুর পরিমাণে ইলিশের সমাগম দেখা যাচ্ছে। অতীতে হাকালুকি হাওরে মাঝে মধ্যে দু’ একটা ইলিশ মাছ নজরে পড়লেও এ বছর এর পরিমান বেশ চোখে পড়ার মত। জানা যায়, আগাম বন্যা ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে এ বছর বেশ আগে ভাগেই হাকালুকি হাওর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন জাতের ছোট-বড় স্বাদু পানির মাছ ইতোমধ্যেই ডিম ছেড়েছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই জেলেদের জালে হাওরের অন্যান্য মাছের সাথে বেশ কিছু ঝাটকা ইলিশও ধরা পড়ছে। এ বারের আগাম বন্যায় হাওর প্লাবিত হওয়ার সাথে ইলিশের প্রজনন মৌসুম মিলে যাওয়াতে বেশী পরিমাণে ঝাটকা ইলিশ হাওরে ঢুকে পড়ছে বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (সিডবিস্নউবিএমপি) কুলাউড়া অফিসের মৎস্য জীববৈচিত্র্য কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকী।
প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ পূর্নিমার ৫ দিন আগে এবং ৫ দিন পরে ডিম ছেড়ে থাকে। এসময় দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদী এবং নদীর সাথে সংযোগ আছে এমন কিছু বিল ও হাওড় অঞ্চলে এদের দেখা মেলে। এছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদীতে এ সময়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় কম পরিমাণে বর্জ্য পানিতে নিষ্কাশনের কারনে অধিক পরিমাণে ইলিশ মাইগ্রেট করার সুযোগ পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া সরকারের ঝাটকা নিধন বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেও ইলিশের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা হয়। ইলিশ মাছ নদীর প্রায় ১২০০-১৩০০ কিঃমিঃ উর্দ্ধে পাওয়া যায় এবং এরা দিনে প্রায় ৭১ কিঃমিঃ পর্যন্ত পরিভ্রমণ করতে পারে। হাওরে প্রাপ্ত এ সকল ইলিশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফ্রেশ ইলিশের স্বাদ একটু ভাল হলেও তা নদীতে প্রাপ্ত অন্যান্য ইলিশের মত অতটা সুস্বাদু নয় বলে জানা যায়। স্রোতের বিপরীতে চলে আসা এসব ঝাটকা অকালে জেলেদের জালে ধরা না পড়লে হাকালুকিতে এ বছর বেশ ভালই ইলিশ পাওয়া যেত বলে ধারণা করা হয়। পরিপক্ক এক একটা ইলিশ মাছ ওজন ভেদে প্রায় ১.০ -২০.০ লক্ষ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে।
প্রশাসনের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই হাওরের ছোট মাছ নিধন রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বিশাল আয়তনের হাওরের তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনসহ কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং গোলাপগঞ্জের উপজেলা প্রশাসন একযোগে কাজ করলে হাওরের মৎস্য সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব বলে স্থানীয়দের ধারণা। এ ক্ষেত্রে জন প্রতিনিধিদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ অতীব জরুরী। হাকালুকির ছোট মাছ রক্ষায় আশু পদক্ষেপ নেয়া না হলে হাওর পাড়ের মুনাফালোভী মহাজন চক্রের কারণে মৎস্য ভাণ্ডার বলে খ্যাত ‘হাকালুকি’ অচিরেই মৎস্য শূন্য হয়ে পড়বে বলে সকলের ধারণা করা হচ্ছে। আর ইলিশ, সেতো অতিথি পাখির মতই এসেছে আবার সুযোগ পেলে চলেও যাবে হয়ত। তবে তাদের বিচরন ও ফিডিং ক্ষেত্র রক্ষা করা গেলে আমরা বারবারই এদের ফিরে পেতে পারি বলে বিশেষজ্ঞগণ ধারণা পোষণ করেন।
Visited 1,069 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?