ফিশারীজ কোন মৌলিক বিজ্ঞান নয় বরং এটি জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের একটি সমন্বিত বিজ্ঞান যা মাছ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশিষ্ট প্রাণীদের জীবতত্ত্ব, চাষ, আবাসস্থল ব্যবস্থাপনা, আহরণ, প্রক্রিয়াজনকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে। তাই ফিশারীজকে বুঝতে হলে অবশ্যই জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্য পূরণকল্পে শুরু হল বিডিফিশ বাংলার পূর্বপাঠ অধ্যায়। এলেখার বিষয় প্রাণীর পেশী ও স্নায়ু কলা। প্রাণীর আবরণী ও যোজক কলা রয়েছে এখানে।  সাথে রইল কুইজে অংশ নেয়ার সুযোগ

পেশী কলা (Muscular tissue):
পেশী কলা সংকোচন ও প্রসারণে সক্ষম এবং অসংখ্য তন্তু নিয়ে গঠিত। এর কোষগুলো নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট এবং সারকোলেমা (Sarcolemma) নামক পর্দা দিয়ে আবৃত। ৭৫ শতাংশ পানি ও ২৫ শতাংশ কঠিন পদার্থে গঠিত কোষগুলো আকৃতিতে সুতার ন্যায় লম্বা বিধায় এদেরকে পেশীতন্তুও বলা হয়ে থাকে। পেশী কলাস্থ কোষের সাইটোপ্লাজমকে সারকোপ্লাজম বল। সারকোপ্লাজমের মধ্যে পরস্পর সমান্তরালভাবে অবস্থিত অসংখ্য উপতন্তু বা মায়োফাইব্রিল (Myofibril) দেখতে পাওয়া যায়। এ কলার আন্তঃকোষীয় ফাঁকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কলা উপস্থিত।

গঠন, কাজ ও অবস্থানের উপর ভিত্তি করে পেশী কলাকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা- রৈখিক (Striated) বা ঐচ্ছিক (Voluntary) পেশী, মসৃণ (Non-striated) বা অনৈচ্ছিক (Involuntary) পেশী এবং হৃদ (Cardiac) পেশী।

  • রৈখিক (Striated) বা ঐচ্ছিক (Voluntary) পেশী:
    • নলাকার তথা সিলিন্ডার (Cylinder) আকৃতির কোষগুলো গুচ্ছাকারে অবস্থান করে এবং প্রতিটি গুচ্ছের চারপাশে যোজক কলার একটি আবরণ থাকে। প্রতিটি কোষ সারকোলেমা নামক আবরণে আবৃত আবৃত এবং আবরণের নিচেই অর্থাৎ কোষের পরিধীর দিকে কয়েকশ গোলাকার বা ডিম্বাকার নিউক্লিয়াই (নিউক্লিয়াসের বহুবচন) দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি কোষে লম্বালম্বিভাবে সূক্ষ্ম উপতন্তু তথা মাইয়োফাইব্রিল দেখতে পাওয়া যায়। কোষগুলির মাইয়োফাইব্রিলে কিছুদূর পর পর অনুপ্রস্থ রেখা বা দাগ দেখতে পাওয়া যায় (তাই একে রৈখিক বা চিহ্নিত পেশী বলা হয়)। মানুষের ঐচ্ছিক পেশী দৈর্ঘ্যে ১-৪ সেমি এবং ১০-৪০ মাইক্রন হয়ে থাকে।
    • অস্থির সংযোগস্থলে বেশী পাওয়া যায় বলে একে কংকাল পেশীও বলা হয়। এছাড়াও চোখ, জিহ্বা, গলবিল, উদরগাত্র ইত্যাদি অঙ্গে এ পেশী দেখতে পাওয়া যায়।
    • অস্থি সংলগ্ন এ পেশী কলার সংকোচন-প্রসারণে প্রাণীর নড়ন ও চলন সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ পেশীর সংকোচন-প্রসারণ প্রাণীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল বিধায় একে ঐচ্ছিক পেশী বলা হয়।
  • মসৃণ (Non-striated) বা অনৈচ্ছিক (Involuntary) পেশী:
    • মাকু আকৃতির এ পেশীর উভয় প্রান্ত সরু এবং মধ্যাংশ প্রশস্ত। মধ্যাংশে একটি নিউক্লিয়াস উপস্থিত। সারকোলেমায় মাইয়োফাইব্রিল উপস্থিত তবে অনুপ্রস্থ রেখা বা দাগ অনুপস্থিত (তাই একে মসৃণ পেশী বলা হয়)। মানুষের অনৈচ্ছিক পেশী দৈর্ঘ্যে ০.০২-০.০৫ মিমি এবং প্রস্থে ৮-১০ মাইক্রন হয়ে থাকে।
    • পৌষ্টিকনালী, শ্বাসনালী, রেচন-জনন নলী, রক্তনালী, লসিকা নালী, গ্রন্থীনালী, চোখের সিলীয় পেশী ইত্যাদি অঙ্গে এ পেশী দেখতে পাওয়া যায়।
    • এ পেশীর সংকোচন-প্রসারণ প্রাণীর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয় বিধায় একে অনৈচ্ছিক পেশী বলে। এ পেশী সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন নালীর ভেতর দিয়ে বিভিন্ন বস্তুর চলাচলে ভূমিকা রাখে। যেমন- পৌষ্টিকনালীর মধ্য দিয়ে পেরিস্ট্যালসিস (Peristalsis) প্রক্রিয়ায় খাদ্যবস্তু সম্মুখ থেকে পেছনের দিকে ধাবিত হয়।
  • হৃদ (Cardiac) পেশী:
    • সারকোলেমায় আবৃত নলাকার তথা সিলিন্ডার (Cylinder) আকৃতির কোষগুলো সমান্তরালভাবে গুচ্ছাকারে অবস্থান করে। পাশাপাশি অবস্থিত কোষগুলো অনিয়মিতভাবে একে ওপরের সাথে শাখার মাধ্যমে যুক্ত থেকে জালের মত একটা গঠন তৈরি করে। অন্যদিকে উপর-নিচে অবস্থিত কোষগুলোর সংযোগস্থলে কোষপর্দা ঘনভাবে হয়ে অনুপ্রস্থ রেখার সৃষ্টি করে যা ইন্টারক্যালেটেড ডিস্ক (Intercalated disc) নামে পরিচিত। এ কলার কোষের নিউক্লিয়াসের সংখ্যা একটি এবং কোষের কেন্দ্রে অবস্থান করে। মানুষের হৃদ পেশী দৈর্ঘ্যে প্রায় ০.৮ মিমি এবং প্রস্থে ১২-১৫ মাইক্রন হয়ে থাকে।
    • কেবলমাত্র হৃদযন্ত্রের প্রাচীরেই এ পেশী দেখতে পাওয়া যায়।
    • দ্রুত এবং ক্লান্তিহীন এ পেশী হৃদযন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণ ঘটিয়ে দেহে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাই এর কাজ। গঠনের দিক দিয়ে এ পেশীর সাথে রৈখিক পেশীর অধিক মিল থাকলেও কাজের দিক থেকে এটি অনৈচ্ছিক পেশীর অনুরূপ।

 

স্নায়ু কলা (Nervous tissue):
এ কলা গ্রাহক অঙ্গের (Receptor organ) মাধ্যমে উদ্দীপনা গ্রহণ করে সে মোতাবেক কার্যকারক অঙ্গের (Effector organ) মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে। এ কলার প্রধান উপাদান স্নায়ুকোষ বা নিউরোন (Neurone)। এছাড়াও নিউরোগ্লিয়া (Neuroglia) কোষ স্নায়ুকোষের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করে স্নায়ুকোষকে সুরক্ষা দেয়।

স্নায়ুকোষ অর্থাৎ নিউরোন এর গঠন: 

নিউরোনের প্রধান অংশ দুটি। যথা- কোষ দেহ ও প্রলম্বিত অংশ

  • কোষ দেহ:
    নিউরোনের কোষ দেহ কোষআবরণী, সাইটোপ্লাজম ও একটিমাত্র নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত। এটিই এর মূল অংশ যা প্রজাতিভেদে গোলাকার, ডিম্বাকার, নক্ষত্রাকার, সূঁচালোকার ইত্যাদি আকারের হয়ে থাকে। মানুষের কোষ দেহের ব্যাস ৫ – ১২০ মাইক্রন হয়ে থাকে।
  • প্রলম্বিত অংশ:
    • কোষ দেহ থেকে বেড় হওয়া শাখা-প্রশাখা নিয়ে প্রলম্বিত অংশ গঠিত। এগুলো দু ধরণের। যথা- অ্যাক্সন (Axon) ও ডেনড্রাইট (Dendrite)।
    • কোষ দেহ থেকে উৎপন্ন সবচেয়ে লম্বা শাখাহীন প্রলম্বিত অংশ অ্যাক্সন নামে পরিচিত। অ্যাক্সনের চারপাশে নিউরিলেমা (Neurilemma) নামক একটি আবরণ বর্তমান। নিউরিলেমা আবৃত অ্যাক্সনকে স্নায়ুতন্তু (Nerve fibre) বলে। নিউরিলেমা ও অ্যাক্সনের মধ্যে স্নেহ পদার্থের একটি স্তর থাকে যাকে মায়েলিন (Myelin) বা মেডুলারি আবরণ (Medullary sheath) বলে। তবে স্তরটি নিরবিচ্ছিন্ন নয় বরং এটি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর র‍্যানভিয়ারের নোড (Node of Ranvier) নামক পর্ব দ্বারা বিচ্ছিন্ন। র‍্যানভিয়ার নোড বা পর্বে মায়েলিন অনুপস্থিত থাকে বিধায় ঐ অংশে নিউরিলেমা ও অ্যাক্সন পরস্পরের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসে। প্রতিটি নোডে সোয়ান (Schwann) কোষ বর্তমান যা মূলত নিউরোগ্লিয়া (Neuroglia) কোষ।
    • কোষ দেহ থেকে উৎপন্ন শাখা বিশিষ্ট এক বা ততোধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রলম্বিত অংশ দেখতে পাওয়া যায় যাকে ডেনড্রাইট (Dendrite) বলে। অ্যাক্সোনের তুলনায় এটি বহু গুণ খাটো এবং সংখ্যায় এক বা একাধিক তবে অনুপস্থিতও হতে পারে। এরা শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট তবে এতে মায়েলিন বা মেডুলারি আবরণ থাকে না এমন কি র‍্যানভিয়ারের নোডও অনুপস্থিত।

স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের কাজ:

  • একটি নিউরোনের অ্যাক্সোন অন্য একটি নিউরোনের ডেনড্রাইটের সাথে স্পর্শহীনভাবে একটি সংযোগ তৈরি করে যাকে সিন্যাপ্স (Synapse) বলা হয়। এ সংযোগের মাধ্যমে অ্যাক্সন নিজ কোষ দেহে উদ্দীপনা অন্য কোষ দেহে পাঠায় অন্যদিকে ডেনড্রাইট অন্য কোষ দেহের উদ্দীপনা নিজ কোষ দেহে নিয়ে আসে।
  • এভাবে নিউরোন পরিবেশ ও প্রাণীদেহের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে প্রাণীর সকল শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।
  • এছাড়াও স্নায়ুকোষ বা নিউরোন বিভিন্ন উদ্দীপনা বা ঘটনাকে মস্তিষ্কের স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে রাখে।

স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের প্রকারভেদ:

একটি স্নায়ুকোষ তথা নিউরোনের কোষ দেহে অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট এর সংখ্যা ও অবস্থানের উপর ভিত্তি করে নিউরোন কে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • মেরুহীন (Apolar) নিউরোন: এ ধরনের নিউরোনের কোষ দেহে অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট উভয়ই অনুপস্থিত।
  • একমেরু (Unipolar) নিউরোন: এ ধরনের নিউরোনের কোষ দেহে একটি মাত্র অ্যাক্সন উপস্থিত।
  • দ্বিমেরু (Bipolar) নিউরোন: এ ধরনের নিউরোনের কোষ দেহের একপাশে একটি অ্যাক্সন এবং বিপরীত প্রান্তে একটি ডেনড্রাইট উপস্থিত।
  • ভ্রান্ত একমেরু (Pseudounipolar) নিউরোন: এ ধরনের নিউরোনের কোষ দেহে একটি করে অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট একই স্থান থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে।
  • বহুমেরু (Multipolar) নিউরোন: এ ধরনের নিউরোনের কোষ দেহে একটি মাত্র অ্যাক্সন থাকে এবং একাধিক ডেনড্রাইট কোষ দেহের বিভিন্ন দিক থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকে। বেশীরভাগ (প্রায় ৯৯%) নিউরোনই এ ধরনের।

 

তথ্যসূত্র:

 

আবরণী, যোজক, পেশী ও স্নায়ু কলা বিষয়ক কুইজে অংশ নিতে লিঙ্কটি অনুসরণ করুন

 


Visited 11,264 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
কলা: পেশী ও স্নায়ু

Visitors' Opinion

Tagged on:                                                                                                                             

রাহাত পারভীন রীপা

প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিস্তারিত

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.