অধিকাংশ স্তন্যপায়ী স্থলচর হলেও পৃথিবীতে বেশকিছু জলচর স্তন্যপায়ীও দেখতে পাওয়া যায় যারা জলজ স্তন্যপায়ী হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে অনেকে সম্পূর্ণভাবে জলজ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ এরা খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য সারা জীবনকাল ব্যাপী জলে অবস্থান করে। যেমন- শুশুক (Dolphin), তিমি (Whale) ইত্যাদি। অন্যদিকে অনেকে আবার আংশিকভাবে জলজ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ এরা মূলত স্থলে বসবাস করে কিন্তু খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য অস্থায়ীভাবে জলে অবস্থান করে। যেমন- সিল (Seals), ভোঁদড় (Otters), বিবর (Beavers), জলহস্তী (Hippopotamus), প্লাটিপাস (Platypus), ক্যাপিব্যারা (Capybara) ইত্যাদি। জলজ পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এদের শারিরিক গঠন নানাভাবে অভিযোজিত হয়েছে। অস্থায়ীভাবে জলে অবস্থানকারী স্তন্যপায়ীদের চেয়ে স্থায়ী জলচর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ লেখায় এ বিষয়টিই বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

উত্তর আমেরিকার নদীর ভোঁদড়
নদীর ভোঁদড় ১

অস্থায়ীভাবে জলে অবস্থানকারী স্তন্যপায়ীদের মধ্যে জলীয় পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সেসব পরিবর্তন তথা অভিযোজন দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হল-

  • এদের বহিঃকর্ণ (External ear or Pinnae) তুলনামূলক ছোট হয়ে থাকে যাতে সাঁতার কাটার সময় কম বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়।
  • পায়ের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের সাথে পর্দা (Membrane) দিয়ে যুক্ত থাকে যা (Webbed Feet) সাঁতার কাটায় বিশেষভাবে উপযোগী।
  • সাধারণত লেজ চ্যাপ্টা (Flattened Tail) হয়ে থাকে।
  • ত্বকের নীচে চর্বির (Fat) স্তর উপস্থিত যার ফলশ্রুতিতে দেহস্থ তাপ না হারিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জলে অবস্থান করা সম্ভব হয়।

 

স্থায়ী জলচর স্তন্যপায়ীরা জলজ পরিবেশের সাথে অভিযোজিত থাকে যেসব কৌশলের মাধ্যমে সেগুলোকে বৃহৎ পরিসরে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

 

নতুন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব (Development of New Stucture)

আনুভূমিক তলে বিস্তৃত লেজ (Tail Flukes):

  • বৃহদাকৃতির লেজ উপরে-নিচে (Dorso-ventrally) চাপা এবং পার্শ্বীয় বা আনুভূমিক তলে বিস্তৃত হয়ে টেল ফ্লুক (Tail Flukes) তৈরি করে।
  • মাছের পুচ্ছ পাখনার মত এদের টেল ফ্লুকে পাখনা-রশ্মির (Fin-rays) অবলম্বন থাকে না।
  • টেল ফ্লুক (Tail Flukes) তাদেরকে সম্মুখদিকে অগ্রসর হতে যেমন সাহায্য করে তেমনই দ্রুত উপর-নীচে গমনাগমনে সাহায্য করে থাকে।

 

ফিনব্যাক তিমি (The Finback Whale)
ফিনব্যাক তিমি (The Finback Whale) ২

 

চর্বিময় পৃষ্ঠ পাখনার উপস্থিতি:

  • অধিকাংশ স্থায়ী জলজ স্তন্যপায়ীদের পৃষ্ঠদেশে অন্তঃকঙ্কাল বা পাখনা-রশ্মির অবলম্বনহীন চর্বিময় পৃষ্ঠ পাখনা (Adipose Dorsal Fin) দেখতে পাওয়া যায়।
  • এটি সাঁতারের সময় হালের (Rudder or Keel) ন্যায় কাজ করে।

 

ত্বক নিম্নস্থ পুরু চর্বিস্তর (Blubber) বর্তমান:

  • এদের ত্বক নিম্নস্থ পুরু চর্বিস্তর বর্তমান যা ব্লাবার (Blubber) নামে পরিচিত।
  • এটি দেহের ওজনের শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।
  • ব্লাবার (Blubber) তাপ অপরিবাহী হওয়ায় এটি জলীয় পরিবেশে দেহস্থ তাপ হারাতে বাঁধা দেয়।
  • পুরু চর্বিস্তরের মাধ্যমে এরা খাদ্য ও পানি সঞ্চয় করে রাখে যাতে জরুরী প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারে।
  • এটি প্রাণীর অভিকর্ষীয় বল (Gravity) তথা ভার (weight) কমায় যা তাদেরকে সহজেই ভেসে থাকতে সহায়তা করে।
  • এটি প্রাণীদেহকে একটি স্থিতিস্থাপক (Elastic) আবরণ (Covering) প্রদান করে যা গভীর সমুদ্রে প্রাণীর দেহের আয়তন কমাতে সহায়তা করে এবং জলীয়চাপ থেকে দেহকে রক্ষা করে।

 

ব্যালিন (Baleen) বা তিমি-হাড় (Whale-bone) বর্তমান:

  • হোয়েল-বোন তিমির (Whale-bone whale) মুখগহ্বরের অভ্যন্তরে ব্যালিন নামক গঠন দেখতে পাওয়া যায় যা খাবার সংগ্রহে ছাঁকনির মত কাজ করে।
  • দুটি প্রধান অংশ নিয়ে এটি গঠিত। এক. ব্যালিন প্লেট (Baleen Plate): এটি ত্রিকোণাকৃতির শৃঙ্গায়িত প্লেট (Horny Plate) আকৃতির হাড় যা উপরের চোয়ালের সাথে দুই সারিতে অবস্থান করে। প্রজাতিভেদে এটি লম্বায় প্রায় ০.৫ থেকে ৩.৫ মিটার পর্যন্ত এবং ওজনে ৯০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দুই. ব্যালিন চুল (Baleen Hair/Bristles): এটি ব্যালিন বোন থেকে চুলের মতো ঝুলে থেকে চিরুনির দাঁতের মত অবস্থান করে ছাঁকনির কাজ করে।
  • ব্যালিনের মাধ্যমে এদের খাবার (প্ল্যাঙ্কটন (Plankton), বেশিরভাগই ক্রিল (Krill)) ছেঁকে সংগ্রহ করে।

 

ব্যালিন প্লেট (Baleen Plate) থেকে ঝুলে থাকা ব্যালিন চুল (Baleen Hair)
ব্যালিন প্লেট (Baleen Plate) থেকে ঝুলে থাকা ব্যালিন চুল (Baleen Hair) ৩

 

ফোম (Foam) এর উপস্থিতি:

  • জলজ স্তন্যপায়ীদের উভয় মধ্য-কর্ণের গহ্বর ভেতরের দিকে করোটির নীচ দিয়ে বর্ধিত হয়ে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে যা ফোম (Foam) এ পূর্ণ।
  • উল্লেখিত ফোম  (Foam) চর্বি (Fat), মিউকাস (Mucus) ও গ্যাসের (Gas) সংমিশ্রণে গঠিত হয়।
  • এটি পানির নীচে শ্রবণের ক্ষমতা বাড়ায়।

 

মেলন (Melon) বর্তমান:

  • মেলন (Melon) নামক এক ধরনের গ্রাহক ইন্দ্রিয় নাসারন্ধ্রের (Nostril) সম্মুখে অবস্থিত।
  • এটি গঠনগত দিক থেকে চর্বির পিণ্ড।
  • পানির চাপের পরিবর্তন সনাক্ত করাই এর কাজ।

 

হার্ডেরিয়ান গ্রন্থি (Harderian Glands) উপস্থিত:

  • চোখের নিকটে অবস্থিত হার্ডেরিয়ান গ্রন্থি থেকে বিশেষ ধরণের তৈলজাতীয় তরল (Fatty secretion) নিঃসৃত হয়।
  • এই নিঃসরণ পানির নীচে চোখকে ক্ষতিকর প্রভাব রক্ষা করে থাকে।

 


আনুভূমিক তলে বিস্তৃত লেজ (Tail Flukes)

 

আদি বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তি (Loss of Original Structure)

লোমের (Hair) হ্রাসপ্রাপ্তি:

  • লোম (Hair) স্তন্যপায়ীদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু জলজ স্তন্যপায়ীদের ত্বক প্রায় লোম বিহীন ও মসৃণ।
  • কেবলমাত্র তুণ্ড (Snout) বা ঠোঁটে (Lips) ছোট আকারের কিছু লোম বর্তমান।

 

বহিঃকর্ণ (Pinnae) অনুপস্থিত:

  • এদের বহিঃকর্ণ (Pinnae) দেখতে পাওয়া যায় না।
  • ফলশ্রুতিতে সাঁতার কাটার সময় এরা পানির প্রবাহ দ্বারা কম বাঁধা প্রাপ্ত হয়।

 

বিভিন্ন ধরণের গ্রন্থির (Glands) অনুপস্থিতি:

  • স্থলচর স্তন্যপায়ীদের সাধারণত যেসব গ্রন্থি দেখা যায় তার বেশিরভাগই জলজ স্তন্যপায়ীতে অনুপস্থিত। যেমন- অশ্রু গ্রন্থি (Lacrimal gland), ঘর্ম বা স্বেদ গ্রন্থি (Sweat or Sudoriferous), তৈল গ্রন্থি (Sebaceous) ইত্যাদি জলজ স্তন্যপায়ীতে অনুপস্থিত।
  • পানির নিচে এসব গ্রন্থির কোন কাজ না থাকাই এর কারণ বলে বিবেচনা করা হয়।

 

নিকটিটেটিং আবরণ (Nictitating membrane) অনুপস্থিতি:

  • চোখ রক্ষাকারী নিকটিটেটিং আবরণ (Nictitating membrane) অনুপস্থিত।

 

পুরু ত্বকে পেশী (Muscles) ও স্নায়ু (Nerves) কলার অনুপস্থিতি:

  • এদের ত্বক পুরু ও অনড় প্রকৃতির এবং পেশী ও স্নায়ু কলা বিহীন।

 

আঙ্গুলের নখ (Nail) অনুপস্থিত:

  • ভ্রূণীয় দশায় এদের আঙ্গুলে নখ উপস্থিত থাকলেও ভূমিষ্ঠ ও পরিণত প্রাণীর আঙ্গুলে নখ অনুপস্থিত।

 

শুক্রাশয় (Testes) ও শুক্রাশয় থলি (Scrotal sac) :

  • শুক্রাশয় উদরে (Abdomen) অর্থাৎ দেহাভ্যন্তরে অবস্থিত।
  • শুক্রাশয় থলি (Scrotal sac) অনুপস্থিত।

 

অগ্রপদ (Fore-limbs) ও পশ্চাৎপদ (Hind-limbs):

  • এদের অগ্রপদ আদি প্রকৃতির (Rudimentary) এবং খর্বাকার কিন্তু প্রশস্ত ও চ্যাপ্টা দাঁড়ের আকৃতির (Paddle-like) ফ্লিপার (Flipper) তথা চ্যাপ্টা পদ গঠন করে।
  • এদের পশ্চাৎপদ ভ্রূণীয় দশায় বোতাম আকৃতির নবের (Button like knob) ন্যায় গঠন বিশিষ্ট হয়ে থাকে যদিও পরিণত প্রাণীতে তা অনুপস্থিত।

 

প্রিয় পাঠক, এ লেখায় অস্থায়ী জলজ স্তন্যপায়ীদের বিভিন্ন পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং স্থায়ী স্তন্যপায়ীদের নতুন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব (Development of New Structure) এবং আদি বৈশিষ্ট্যের অবলুপ্তি (Loss of Original Structure) সম্পর্কে আলোচনা করা হল। আগামী পর্বে থাকবে স্থায়ী জলজ স্তন্যপায়ীদের মূল বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন (Modification of Original Structure) সম্পর্কে।

 

চিত্র-সূত্র:

 


Visited 3,365 times, 1 visits today | Have any fisheries relevant question?
জলজ স্তন্যপায়ীদের অভিযোজন: পর্ব-১

Visitors' Opinion

এ বি এম মহসিন

প্রফেসর, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫, বাংলাদেশ। বিস্তারিত ...

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.